“….করবেই ইতিহাস উপহাস, থেকোনা অন্য ভাষার ক্রীতদাস।”

Agnish Kumar Das
3 min readFeb 21, 2024

--

ইন্টারনেটে এক ঝলক তাকালে জানা যায় যে এই পৃথিবীতে প্রায় সাত হাজার ভাষা আছে এবং তার মধ্যে মাত্র তিনশো মতন ভাষা লিখিত হরফে আছে৷ অতএব এই বিশ্বের অধিকাংশ ভাষাই “মুখে মুখে ফেরা মানুষের” কণ্ঠস্বরের মাধ্যমেই বেঁচে আছেন৷ যেহেতু এই সকল ভাষার কোন দলিল-দস্তাবেজ নেই, প্রত্যেকদিনই কোন না কোন ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে আর তার সাথে অতল সমুদ্রে তলিয়ে যাচ্ছে এক একটা সভ্যতার ইতিহাস৷

ভাষা, মানুষের মধ্যে যোগ সুত্র স্থাপনের সব থেকে ব্যবহৃত মাধ্যম৷ এই যে পৃথিবীর মানচিত্রে এতগুলো ভাষার বসবাস, তাদের মধ্যে কি কোন সাদৃশ্য আছে? অর্থাৎ এমন একটা পানশালা, যে পানশালায় এই সব ভাষাই আসেন জিরিয়ে নিতে? এই প্রশ্নের উত্তরটা আমার কাছে কিরকম, সেটা আপনাদের কাছে সাজিয়ে তুলতেই আজকের এই লেখা৷ খুব সহজেই বলা যায় যে সব ভাষায় উপন্যাস লেখা হয়নি, নাটকও লেখা হয়নি, কবিতা লেখা হয়নি। কিন্তু সব ভাষাতেই গান বাঁধা হয়েছে (আমি ইচ্ছাকৃতভাবেই ‘লেখা’ শব্দটা ব্যবহার করলাম না)৷ গান সেই বিশেষ ঘাট যেখানে সব ভাষাই সকালে সূর্যোদয় আলিঙ্গন করতে আসে, সেই বিশেষ পানশালা যেখানে সব ভাষাই জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সন্ধ্যাবেলায় জিরিয়ে নিতে আসেন৷

মহান সঙ্গীতস্রষ্টারা, সুরস্রষ্টারা বলবেন যে, “সঙ্গীতের কোন ভাষা নেই।” মেনে নিলাম৷ সুরের সত্যিই কোন ভাষা নেই। কিন্তু গানের ভাষা আছে এবং গান ভীষণভাবেই একটা ভাষানির্ভর শিল্প। যদি তা না হত, তাহলে ভারতবর্ষের প্রত্যন্ত গ্রামের যুদ্ধে শহিদ হওয়া সন্তানের দেহ গ্রামে ফিরলে, তাঁকে সম্মান জানিয়ে, বব ডিলানের “নকিং অন হেভেনস ডোর” বাজানো হত৷ তা হয়না৷ ভাষার বৈচিত্র্যময় দুনিয়ায় কী সৃষ্টি হওয়া গান একঘেয়ে? না, একঘেয়ে নয়৷ গানেও বিরাট বৈচিত্র আছে৷ সঙ্গীতবোদ্ধারা এর পুরো কৃতিত্বটাই সুরকে দিয়ে থাকেন৷ আমি একটু অন্য পথে হাঁটছি৷ আমার বিশ্বাস এতে ভাষার একটা প্রত্যক্ষ ভূমিকা আছে৷

প্রত্যেকটা ভাষারই একটা নিজস্ব চলন থাকে। সকল ভাষার নিজস্ব অন্তর্নিহিত তাল, ছন্দ থাকে৷ এই চলন, তাল, ছন্দের প্রভাব বিবিধ ভাষায় সৃষ্টি হওয়া গানের সুরকে একে ওপরের থেকে খানিকটা হলেও আলাদা করে দেয়৷ ভাষার মধ্যেই বহমান থাকে সেই ভাষাভাষী মানুষের রাজনীতি এবং তার প্রভাব স্বভাবতই গানে দেখা যায়৷ এবার পালা আমার ছোট মুখে বড় কথা বলার৷ উপরে উক্ত যুক্তিগুলো মেনে নিলে, একটি ভাষাই তফাতে দাঁড়ায়৷ যে ভাষায় আমি এই লেখাটা লিখছি৷ বাংলা ভাষা৷

বিশ্বে দ্বিতীয় কোন ভাষার জন্য মানুষ প্রাণ দিয়েছে বলে জানিনা৷ বাংলা ভাষার জন্য একটা নয়, একাধিক আন্দোলন হয়েছে। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন ও ভারতের বরাক উপত্যকায় ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে শহিদ হয়েছেন বাংলা ভাষার অগণিত বীর-বীরাঙ্গেরা। তবে বাংলা ভাষার গানের দুনিয়ায় একক স্থানের কারণ এটা নয়৷ বিশ্বে যতরকম গান হয়েছে, তার সবকটা না’হলেও অধিকাংশের ছাপ একমাত্র বাংলা গানে পাওয়া যায়, আর অন্য কোন ভাষার গানে এই মারাত্বক বিবিধতা এবং ভাষার কোলে সহবস্থান লক্ষ্য করা যায় না৷ বাংলা ভাষা খুব অদ্ভুতভাবে বিশ্বের নানান ধারার গানের রসদ শুষেছেন, এবং নির্বিঘ্নে সৃষ্টি হয়েছে কোন বিলেতি গান নয়, নতুন ধরনের বাংলা গান৷ বাংলা গানে গজল হয়েছে, খেয়াল হয়েছে, কাওয়ালি হয়েছে, টপ্পা হয়েছে, রক হয়েছে, র‍্যাপ হয়েছে, ব্লুজ হয়েছে, জ্যাজ হয়েছে, এবং আরো আরো আরো৷

আমাদের প্রজন্মের অনেকেই হয়েত’ আমার এই কথার সাথে সহমত হবেন যে আমাদের কাছে বাংলা ভাষার গাড়ি চালিয়েছে বাংলা গান। কখনো সেই গাড়ির চালকের নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কখনো কাজী নজরুল ইসলাম, কখনো নচিকেতা চক্রবর্তী, কখনো কবীর সুমন, কখনো অঞ্জন দত্ত, কখনো প্রতুল মুখোপাধ্যায়, কখনো গৌতম চট্টোপাধ্যায়, কখনো রূপম ইসলাম, কখনো অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়, কখনো চন্দ্রিল ভট্টাচার্য, কখনো অনুপম রায়, কখনো মৌসুমি ভৌমিক, কখনো লালন ফকির, কখনো শাহ অব্দুল করিম, কখনো এন্টনী ফিরিঙ্গী, কখনো হেমাঙ্গ বিশ্বাস, কখনো সলিল চৌধুরী, কখনো অতুলপ্রসাদ সেন, কখনো নাম না জানা অজস্র পল্লীগীতি স্রষ্টারা ৷ অথচ অদ্ভুতভাবে, বাংলা ভাষা নিয়ে আলোচনা সভায়, বিতর্কসভায় প্রায় কোনদিনই বাংলা গান থেকে উঠে আসা কোন মানুষকে বাংলা ভাষার প্রতিনিধিত্ব করতে দেখিনা৷ এটা বোধহয় পশ্চিমবঙ্গেই সম্ভব৷ যাঁদের নাম আমি লিখলাম তাঁদের নিয়ে মাতামাতি আমরা করি বটে, কিন্তু তাঁদের বাংলা ভাষার জন্যে অবদানকে আমরা স্বীকৃতি জানাই কি? আমার মনেহয় জানাই না৷

জানাই না বলেই, কৌশলে আপনার বাড়িতে একলা দুপুরে ঝিমিয়ে যাওয়া রেড়িওটায় আধুনিক বাংলা গান বাজে না, বাংলার রিয়ালটি শো-তে বাংলা গান গাওয়া হয় না৷ আজ বাংলা গানের অসংখ্য গীতিকবিদের বাংলা ভাষার প্রতি অবদানকে ইন্টারনেটের পাতায় কুর্নিশ জানানোর জন্যই এই লেখা৷ ন্যাকামি করে, “বাংলা গানের পাশে দাঁড়ান” বলবো না৷ বাংলা গানের পাশে দাঁড়িয়ে লাভও নেই কারণ সে একটা বহমান নদী৷ সে ঠিক নিজের খেয়ালে চলবে৷ আপনাদের শুধু একটু সজাগ হতে বলছি৷

এই লেখার শিরোনাম আমি ধার নিয়েছি নচিকেতা চক্রবর্তীর লেখা একটি গানের লাইন থেকে৷ শেষ করছি কবীর সুমনের লেখা একটি গানের লাইন দিয়ে৷

“মুখে মুখে ফেরা মানুষের গানে, শুধু তোমাকেই চাই”৷

সারা বিশ্বের অজস্র গীতিকবিদের, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের রক্তিম অভিনন্দন৷

Sign up to discover human stories that deepen your understanding of the world.

Free

Distraction-free reading. No ads.

Organize your knowledge with lists and highlights.

Tell your story. Find your audience.

Membership

Read member-only stories

Support writers you read most

Earn money for your writing

Listen to audio narrations

Read offline with the Medium app

--

--

Agnish Kumar Das
Agnish Kumar Das

Written by Agnish Kumar Das

A budding forest ecologist who loves writing, birdwatching, and engaging in conversations about most things.

No responses yet

Write a response