একজনকে পারতে দেখেছি।

Agnish Kumar Das
4 min readMay 23, 2024

--

প্রথম পর্ব৷

ছোট থেকেই দেখতাম বিকেলের আলতো স্পর্শ ঘড়ির কাঁটায় লাগলেই, আমারা মা তাঁর দৈনন্দিন ক্লান্তিকে আলিঙ্গন করে, বারান্দায় একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসতেন৷ তখন আমার বয়স বেশ কম, ক্রিকেটের ব্যাট নিয়ে দালানে বিশ্বকাপ ফাইনেলের রুদ্ধশ্বাস ইনিংস খেলার ফাঁকেই একবার মা-কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “কী করছো এখানে বোসে?” মা উত্তরে বলেছিলেন, “এই লোক দেখছি।” আমাদের বাড়ির ঠিক সামনেই অবস্থিত একটি বহুল দর্শিত মন্দির৷ বিকেল নাগাদ সেই মন্দির প্রাঙ্গনে নানা ধর্মাবলম্বী মানুষ জড়ো হয়৷ কেউ হাওয়া খেতে, কেউ ডাক্তারের আদেশ মেনে হাঁটা লাগাতে, কেউ তার প্রণয়ে একটু বিনয় যোগ করতে, কেউ আবার স্রেফ প্রাঙ্গনের চারিপাশের অস্থায়ী দোকানগুলোয় ফুচকা, ভেলপুরির টকঝাল অভিজ্ঞতা নিতে৷ অতএব ক্যালাইডোস্কোপিক মানুষের ভিড় চাক্ষুষ করার একটা সুযোগ এখানে থাকে৷ মা-কে রোজ এটা করতে দেখে, আমিও একদিন দালান থেকে বারান্দায় এসে বসেছিলাম এবং অনুভব করেছিলাম, “কী মজা!”

ঘরছাড়া হয়েছি বেশ কিছু বছর আগে, আর দেশ ছাড়া হয়েছি এই সবেমাত্র এক বছর হোলো। বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার অব্যবহিত পূর্বে আমার মা একেবারে সনাতনী বাঙালী মায়েদের মতন বলেছিলেন, “এতদূর একা একা যাবে ছেলেটা।” নানান ব্যস্ততার কারণে সেইদিন কথাটায় বিশেষ কর্ণপাত করিনি। অবশ্য করলেও তার যে যুতসই উত্তরটা আমার মনের পাতায় স্টেন্সিল দিয়ে লেখা ছিল, সেটা তখন মা-কে দিয়ে উঠতে পারলাম ব’লে মনে হয়না৷ ওই প্রথমবার বারান্দায় ‘লোক দেখতে’ বসার মুহূর্ত থেকেই আমি কোনদিনই ‘একা একা’ কিছুই করিনি৷ মার্কিন কবি, চার্লস বুকাওয়স্কি তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতায় লিখেছিলেন, “আই হ্যাভ বিন আলোন, বাট সেলডম লোনলি”, মানে আমি নিশ্চিতভাবে একা থেকেছি, কিন্তু বিশেষ একলা থাকিনি৷ ঋষিকেশ মুখার্জির ছবিতে ‘আনন্দ’-এর জীবনের একটা স্লোগান ছিল৷ আমার জীবনের যদি কোনো স্লোগান থেকে থাকে, সেটা বোধহয় মার্কিন কবির এই লাইনটা৷

মানুষ বেঁচে থাকে শরীরে, জীবিত থাকে মগজে৷ আপাতদৃষ্টিতে যাকে দ্ব্যর্থহীন সত্যি বলে হয়, তা কেবলই রুচি অনুসারে সাজানো একটা পর্দা মাত্র৷ জীবনের মেনুতে অধিকাংশ জিনিষই ফিশফ্রাই, স্যালাড গোছের, বিরিয়ানিটা ওই মগজে যা চলে, তাই৷ এক বিবাহিত পুরুষের মগজে যদি অন্য কোনো নারী থাকে, তাহলে সেটাই তার জীবন; এক সৎ আন্দোলনকারীর মগজে যদি ক্ষমতার দালালী থাকে, তাহলে সেটাই সত্যি৷ মগজের একটা দোষ আছে৷ সে খানিক বেপরোয়া গোছের৷ কিছু বাচ্চা থাকে যাদের জীবন চালায় তাদের অবিভাবকেররা প্রায় এক স্বৈরাচারীর মতন৷ মগজ সেই বাচ্চাদের দলের কেউ নয়৷ এমনকী সেই বাচ্চাগুলোর মগজও তাদের বাহ্যিক শোষিতরূপী বেঁচে থাকার উর্ধ্বে জীবন কাটায়৷ ‘মগজাস্ত্র’ শব্দের সাথে আলাপ হওয়ার কয়েক বছর আগে থেকেই আমার মগজের সাথে সম্পর্ক৷ তবে, আমার সাথে মগজের সম্পর্কের গতিশীলতার সাথে সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র দেখার অভিজ্ঞতার মধ্যে একটা সাদৃশ্য আছে। গোড়ায় মনেহয় সহজ, স্বাভাবিক, আস্তে আস্তে পেঁয়াজ খোসা ছাড়ায়৷

মগজের সাথে আমার সম্পর্ক স্থাপন হয় ওই প্রথম “লোক দেখতে” বসার সময়৷ তখন বিষয়টা ছিল খুবই সরল। অতরকমের জামাকাপড় গায়ে, অতধরণের মুখ দেখার মধ্যে একটা ভীষণ রোমাঞ্চকর ব্যপার ছিল৷ ধীরেধীরে সেই রোমাঞ্চের ছাঁচ পালটে যায়৷ একটা নেশা ক্রমাগত মগজের রাজত্বে শাসন কায়েম করতে থাকে, আর সেই নেশায় বুঁদ হয়ে জীবন ছিনয়ে নেয় অস্তিত্ব৷ ধরুন জৈষ্ঠ্যের দুপুরে একটা মানুষ হেঁটে যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে, ফুটপাতে অবস্থিত টাইমকলের জলের উগ্র স্রোত দেখে সে থমকে দাঁড়াল৷ মুখে-চোখে জলের ঝাপটা দিয়ে তার হাতের তালুর পাত্র থেকে খানিক জল খেয়ে নিলেন৷ এবার এই মানুষটি আপনার মগজকে অনেকগুলো রাস্তা খুলে দিলো৷ একটা রাস্তা ‘অবাক জলপান’মুখী হতে পারে আবার আপনার মগজ ‘জীবনমুখী’ রাস্তায় হেঁটে ভাবতে পারেন তার রাজনীতি কী, তার বাড়ি কোথায়, সে এই দুপুরে রাস্তায় ঘুরছে কেন, ইত্যাদি, ইত্যাদি, ইত্যাদি৷ নানারকমের উল্কি এঁকে চলতে পারেন; কখনো সে রূপধারণ করবে রামধনুর, কখনো ধূসর আসবাবের, আবার কখনো একটা মধ্যপন্থী রং পেন্সিলের৷ পাশাপাশি, অজান্তেই আপনি উঠবেন অন্য একজনের গল্পের চরিত্র অথচ ভাবুন, সেই গল্পের লেখক কিন্তু আপনি বা বলা ভালো, আপনার মগজ৷ যে নেশায় এমন বৈপরীত্যের সুক্ষ্ম, এলাহী উদযাপন বিরাজমান, সেই নেশা একা করে ঠিকই কিন্তু একলা হতে দেয়না বিশেষ৷

আপনাদের মনে আছে তো আমি দেশছাড়া এই এক বছর হোলো? যাইহোক, এখানে আসার পর, প্রথম যে বাসায় আমি আস্তানা গেড়েছিলাম, সেই জায়গাটা আমার কর্মক্ষেত্র মানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গন থেকে বেশ খানিকটা দূরে ছিল৷ বাস-মেট্রো-বাস, এই ছিল আমার যাতায়াতের বাহন। এই বাহনগুলিতে সওয়ার হয়ে নানান মুখই দেখতে পেতাম৷ বলে রাখা ভালো, কোন মুখে কল্পনার দাবানলের বারুদ আছে, সেটা বোঝা মুশকিল; এবং তার নির্বাচন যে পক্ষপাতহীন, তাও না। সামনে বা পেরিফেরিতে যদি একটা নারী থাকেন যার চোখগুলো তুলির টানের মতন, গালে এই-এসে-চলে-গেল একটা টোল, মাথা থেকে কাঁধ হয়ে গড়িয়ে যাওয়া একটা তমসায় ঘেরা নদীর মতন চুল — হ্যাঁ, আমি তার মুখেই গল্প খুঁজবো৷ পেলে ভালো, না পেলেও অসুবিধা নেই৷ গল্পের মুখ নির্বাচন করার ব্যপারে আমি একেবারেই পেশাদার নই৷ অপেশাদার হওয়া নিয়ে আমার মনে কোনো লজ্জা নেই, বরং কিঞ্চিৎ গর্ব আছে৷ বিদেশে আসার পর প্রথম দুসপ্তাহে কোনো মুখই আমি পাইনি যেটা নিয়ে নিঃশর্ত সময় নষ্ট করা যেতো৷

কিছুদিন পেরিয়ে গেছে। নিয়মমাফিক ঠোঁটের ডগায় সিগারেট ঝুলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাসস্ট্যান্ডের দিকে হেঁটে যাচ্ছিলাম, ঘড়িতে তখন সবে গোধূলি — দেখি বাসস্ট্যান্ডের পাশের একটা বেঞ্চে কাউবয় হ্যাট মাথায় একটা লোক তাঁর বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে এসে বসলেন।

(চলবে)

--

--

Agnish Kumar Das

A budding forest ecologist who loves writing, birdwatching, and engaging in conversations about most things.